প্রাক-কথা
ঝুলিতে কম তো জমল না- এবারে তোলা শুরু হোক আস্তে আস্তে নাকি? কেউ না পড়ুক- বুড়ো বয়সে নিজেই পড়ব- ভাবব আর নিজেকে নিয়ে নিজেই জ্বলব। মনে হবে- ছিলুম বটে এক কেউ ক্যাটা। কলেজ থেকে, আর দেশ থেকে- সংসার গুটোনো তো বলতে গেলে হয়েই গেল। এবারে নাকি সারা পৃথিবী হত্যে দিয়ে পরে আছে আমার জন্য? যেন ফুলসজ্জার রাত্রে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা লজ্জাশীলা বধূ- আর আমি কে কোথাকার সদ্যবিবাহিত পুরুষ, আমার উপস্থিতিতেই বধূর রূপ অন্মোচিত হবে, নচেৎ নয়। লোকজন তো এরকমই বলে। আমার বক্তব্যটা যদিও একটু আলাদা- এরপর আমার অবস্থা হবে মাঝসমুদ্দুরে ভেলায় ভেসে থাকা তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মত। তার চারপাশে জলই জল- তবু সে তৃষ্ণার্ত, তৃষ্ণা মেটাতে সম্বল-সহায়হীণ। ভেসে যাবার দিশার অভাব নেই তাও- অথচ সে সবচেয়ে বড় দিশাহীণ।
কোনটা- দেখা যাবে। আপাতত পেরিয়ে আসা পথের কিছু ছবি তুলে রাখি। নাহলে ফিরতি পথে ক্লান্ত হয়ে ভুলে যাবার সম্ভাবনা প্রকট।
১
২০২৪ পুজোর কলকাতা। শেষ কলকাতার পুজো- আপাতত বেশ লম্বা সময়ের জন্যই। ফিরে তাকাবার উপায় নেই- না অনুমতি আছে নস্টালজিয়া মাথায় পুষে স্লথ হবার। সেসব এখন বিষের মত, মাথায় অশোক সেনের ব্যাটন নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিগিরি চলেনা। আজ থেকে ৫০ বছর বাদে হয়ত অশোক বাবুর মত আমার নাম করেও কোনো বাঙালি কলেজ পড়ুয়া খিস্তিখাস্তা করবে- রক্ত ঝড়বে- আমি হয়ে যাব শ্রেণিশত্রু। আর যদি খিস্তি না করে, তাহলে বুঝব- আমি আজ যে কারণে সব ছেড়ে ছুটে চলেছি ভিড় রাস্তায় রেসে নামা দুটো অটোর মত, সব বৃথা, সব মিথ্যে। তখন নটে গাছটি মুড়োবার পালা এসে উপস্থিত হবে- নিজের হয়ে শুনানী করতে গিয়ে সিধুজ্যাঠা হবার ভান করে নবীন ফেলু মিত্তিরদের দিকে তাকিয়ে বলব- "আমি অনেককিছু করলে অনেকেরই পসার থাকত না, তাই আমি কিছুই করিনি"।
যাই হোক- এই পুজোটা আরেকটা কারণে বিশেষ। এই ২৩ টা বছর কলকাতায় থাকার পরে, রাজনৈতিক জ্ঞান হবার পর থেকেই নিজের প্রজন্মকে গালাগাল করা শুরু করে শেষ অবদি আজ এসে দেখলাম শহরের প্রকৃত রূপ, দেখলাম শিঁরদাড়া তো আছে শহরটার। গত ৯ অগাস্ট একজন জুনিয়ার ডাক্তার আর.জি.কর হাসপাতালে অতি নৃশংসভাবে ধর্ষিতা ও মৃতা হয়েছেন- অভিযুক্তরা নিঃসন্দেহে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা সমর্থিত। শুধু সমর্থিত নয়, হয়ত তারা বড়সড় চেয়ারে বসে থাকা কর্তা-কত্রীদের নানাবিধ দুর্নীতির কোনো একটি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত- যেকারণে অপরাধীদের ধরার জন্য প্রশাসনের নির্বিকারতা নির্লজ্জ রকম প্রকট। শহর নেমেছে রাস্তায়- কলকাতার অভিজাত শিক্ষিত সম্প্রদায় নেমেছে রাজপথে- এমন বিরল দৃশ্যও দেখা গেল। একদিন- দু'দিন নয়, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চলছে আন্দোলন। বিচারের দাবিতে আজ ৬৭ তম দিন। আর বেশ কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনেও নেমেছেন, যা আন্দোলনের সর্বশক্তিমান হাতিয়ার এই মুহূর্তে- তাদের কয়েকজন ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি। একজনেরও কিছু হয়ে গেলে আন্দোলন ফুলকির মত ছড়িয়ে পড়বে, পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যত হবে অনতিপূর্বে পূর্ববঙ্গে ঘটে যাওয়া সরকার উচ্ছেদের সামান্তরিক- এই আশাতেই প্রাণবাজি রেখেছেন ডাক্তারেরা। এই মুহূর্তে আন্দোলন আর শুধু ডাক্তারদের নয়, সমাজের সবার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। গত কয়েকবছরে পৃথিবীতে কম ওলটপালট হয়নি- রাশিয়া- ইউক্রেন, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের বিপ্লব- আরো কত কি। কিন্তু এভাবে চিন্তিত, ভীত ও ক্ষুব্ধ হতে কলকাতাকে আগে দেখিনি। এ যেন নিজের বাড়িতে অশান্তি হলে বাড়ির সবাই যেমন সর্বশক্তি দিয়ে তার উপশম করার চেষ্টা করে তারই মত।
প্রশ্ন তবু আছে। এর আগে সন্দেশখালির মত ঘটনা ঘটে গেছে- যেখানে জানা যায় তৃণমূলের কর্মীরা গ্রামের প্রত্যেকবাড়ির মেয়েদের পালা করে ধর্ষণ করত। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন বহু সন্দেশখালি যে আছে তা সন্দেহেরও অতীত। তখন কিন্তু কলকাতার এই শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায় সেই গ্রামে গিয়ে মাসের পর মাস অপরাধীদের শাস্তি কামনা করে আন্দোলন করেননি। ঠিক যেমন করছেনা আর.জি.কর কান্ডে গ্রামের মানুষেরা। গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মাপকাঠিটা আকাশ-পাতাল আলাদা। কয়েকদিন আগে কোনো এক গ্রামে এক ধর্ষিতা কণ্যার বাড়ির লোক বলেছেন- "মেয়েটা যে বেঁচে আছে এই অনেক"। সমাজের অবক্ষয় যে শুধু বিষাক্ত তাই নয়, বিভেদসৃষ্টিকারীও বটে।
মা দুর্গার আগমন এবছর পালকিতে, যে পালকির গাড়োয়ান দ্রোহ। এই পুজো মৃণ্ময়ীর মুখোশে চিন্ময়ীর সম্মানের লড়াই। সরকার তবু খামতি রাখেনি। পাড়ার ক্লাব, যাদের দিয়ে মূলত রাজ্যটা চালিয়ে থাকে বর্তমান সরকার, তাদের সাড়ম্বরে পুজো করার জন্য নগদ দিয়েছে ভুঁড়ি-ভুঁড়ি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুজোর আগে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলছেন- "উৎসবে ফিরুন"। তাই দশমীর পর সরকারী উদ্যোগে ভাসানের কার্নিভালের দিন মানুষ সাজিয়েছে "দ্রোহের কার্নিভাল"- খোদ এসপ্লানেডের মোড়ে। রেডরোডে ভাসানপথযাত্রী মা দুর্গা দেখেছেন পাশের রাস্তা রাণী রাসমণী এভিনিউতেই তার কণ্যার বিচারের দাবিতে আর জীবিত অসুরদের শাস্তিকামনায় তার আপামর সন্তানদের কাতরতা। তাই নিশ্চিত তিনি ঘরে ফিরেছেন, মৃতা কণ্যার জন্য যতটা দুঃখে, বাকি সন্তানদের জন্য ততটাই গর্ব বুকে নিয়ে।
বেঙ্গালোরে তো থাকলাম ৩ বছর। নাহ- এ শহরে মায়া আছে। এসপ্লানেড মেট্রোস্টেশনের ভিতর সিঁড়ি থেকেই শুরু হয় "We Want Justice" শ্লোগান। গায়ের রোম হর্ষিত হয়। সেই ভিঁড় গরম ঘাম-প্যাচপ্যাচে জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হয়। মেট্রোস্টেশন থেকে বেরোনো মাত্রই ভলান্টিয়ারদের অবাধ প্রসারিত সাহায্যের হাত। আর মেইন রোডে ওঠা মাত্রই চোখে পরে মানুষ, শুধুই মানুষ- নির্জলা খাঁটি এক লাখ মানুষ- সবার মুখে স্বজনহারার শোক, স্বজনহন্তার জন্য কারখানার ফার্নেসের মত দগদগে আগুন, আর লড়াই ধরে রাখার স্বার্থে কমরেডদের জন্য নিঃস্বর্ত ভ্রাতৃত্ববোধ। "মানুষ থেকেই মানুষ আসে, বিরুদ্ধতার ভিঁড় বাড়ায়"- এই বাক্যখান এই শহর ছাড়া আর কোথায় বসেই বা লেখা সম্ভব!
আনন্দবাজারগিরি তো বেশ হল, এবার একটু বাঁকাচোখে তাকাই নিজের দিকে- যেকারণে এই জার্নাল লেখা শুরু। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদ বিবরণ তো আমার বিশেষ জানা ছিলনা। সপ্তমীর সকালে কোলকাতা এসে পৌঁছোবার আগে অবদিও ডাক্তারদের জানানো ১০-দফা দাবী নিয়ে অবগত ছিলামনা- হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কলকাতাবাসী মানুষদের পোস্টে এ সম্পর্কে জানান দেওয়া থাকলেও কলেজের নিরাপদ দেওয়ালঘেরা নিরাপত্তার মধ্যে থেকে সেগুলো পড়ে দেখার প্রয়োজনটুকু বোধ করিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকটা মমতা বাড়ুজ্যে-বিরোধী পোস্ট করেছি এটা মাথায় রেখেই যে তাতে শাসকশ্রেণির কিচ্ছু এসে যায়না- শুধু বুদ্ধিজীবিতার ওয়ালেটে নিজেরই এক্স.পি পয়েন্ট জমা হয় মাত্র। সে পয়েন্ট বাড়লে নিজের প্রজন্মের চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে খাতির বাড়ে, বিশেষত কলকাতানিবাসীনী শিক্ষিতা সুন্দরীদের মধ্যে, যাদের কথা ভেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুব দেয় আমার মত আনসোশ্যাল মানুষরাও।
আর সেই আমি শহরে আসা মাত্রই যে পুজোর আমেজ ভুলে প্রতিবাদ করতে ছুটে গেছি এমনও তো নয়। এসেছি, সপ্তমী থেকে দশমী চুটিয়ে ঘুরেছি- "দেশে শেষ পুজো"-র আবেগটা কিছুতেই এই ভীষণ শক্তিশালী মানবিক দাবিটার কাছে হার মানেনি। একাধিকবার তখন মাথায় এসেছে- যাওয়া কি যায়না একবার? মন বলেছে- কি গরম দেখেছিস? ওই ভীড়ে গিয়ে হাজির হলে লাশ হয়ে ফিরবি। পরমুহূর্তেই আরও মাথায় এসেছে- এমনিতে পুলিশ টুলিশের তোয়াক্কা করিনা, কিন্তু এই সময়ে পুলিশ কেস ঠুকে দিলে তিনমাস বাদে লন্ডন যাবার ভিসা লাটে উঠবে। না না- অনেক খেটেছি, বাপ-মা অনেক খেটেছে- সব জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষুদিরাম হতে আমি পারছিনা।
পুজো শেষ হবার পর যখন পারদ নামল, নেশা কাটল- দেখলাম, কি নির্লজ্জ একটা জানোয়ারে পরিণত হয়েছি আমি। কলকাতা ছাড়ার আগে যে মানুষটা ছিল অতিরিক্ত সহমর্মী, অত্যধিক আবেগপ্রবণ- সে আজ নিজেকে শুধরাতে শুধরাতে ওভারফিটিং করে ফেলেছে নিতান্তই। একটা ঠাণ্ডা সবজীতে পরিণত হয়েছে। তারপরে হঠাৎ এল তীক্ষ্ণ তিরস্কার- জীবনের প্রথম প্রেম থেকে, যার শুরু ও সাঙ্গ সবই কলকাতা শহরে, "তুমি এতটা aloof কিকরে?" এবারে মানুষ হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকে কতটা জানিনা, কিন্তু আবারও সেই সমাজের চোখে ভালো মানুষ থাকার দায়ে, সর্বোপরি নিজের কাছে নিজেকে দেওয়ার মত একটা কৈফিয়ত খুঁজতে উপস্থিত হলাম দ্রোহের কার্নিভালে।
গিয়ে পেলাম অ্যাড্রিনালিনের অফুরন্ত স্রোত- যে হরমোনের ভরসায় আমি বেঁচে আছি- আর যে হরমোনের অভাব হলে মাথায় আত্মঘাতী চিন্তাও উঁকি মেরে যায়। তাই বেশ লাগল- এত মানুষ, এত উদ্যোগ, এত দুঃসাহস। নিজেকে বেশ বীর-বীর মনে হল- এসে লাভ হয়েছে বলতে হবে। তারপরে দেখা হল সেই প্রথম প্রেমের সাথে, সঙ্গে অন্য এক ছেলে। কয়েক মিনিটের জন্য পায়ের তলার মাটি সরে গেল, চোখে অন্ধকার দেখলাম- কেন কি করতেই বা দিন দুপুরে এসপ্লানেডে এসছি- বিস্মৃত হলাম।
কি ঠুনকো আমার বিপ্লব চেতনা, জীবনে কতকটা ভান আর কতকটা সত্যি- নাহ, ভেবে কাজ নেই। জীবনে ফিরি।
No comments:
Post a Comment